কোন ব্যক্তি ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না সে তার পিতা-মাতা, এবং তার সন্তান ও সমস্ত মানুষ থেকে আমাকে বেশি মোহাব্বত করবে। {সহীহ বুখারী শরিফ, হাদীস নং-১৫, সহীহ মুসলিম শরিফ, হাদীস নং-১৭৭}

Thursday, April 21, 2022

মহা দুর্ভিক্ষ ।। ইসলাম ও ইতিহাস।

 ইতিহাসে এক মহা দুর্ভিক্ষের ঘটনা।

মহাদুর্ভিক্ষ।। famine


তখন হযরত ইউসুফ আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিশরের বাদশা হয়ে গেলেন। তিনি ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করতে লাগলেন এবং আসন্ন দুর্ভিক্ষের কথা চিন্তা করে খাদ্যশস্য উৎপাদন সংগ্রহ এবং বড় বড় খাদ্যভান্ডার তৈরি করতে লাগলেন। তারপর উনার দেখা স্বপ্ন অনুযায়ী দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। চারিদিকে খাদ্যের জন্য হাহাকার লেগে গেল। সমগ্র দেশ এর কারণে মহা বিপদে পতিত হলো। তখন সবাই খাদ্য ক্রয়ের জন্য মিশরের দিকে আসতে লাগলো। হযরত ইউসুফ আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাউকে একটি উটের বেশি বোঝাই করা খাদ্যশস্য দিতেন না। এর কারণ হলো যাতে করে সবাই সমানভাবে খাদ্যশস্য ক্রয় করে নিতে পারে।


তখনকার কেনান শহরে এর দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে হযরত ইয়াকুব আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুত্র বেনিয়ামীনকে রেখে বাকি ১০ ছেলেকে মিশরে পাঠালেন খাদ্যশস্য ক্রয় করার জন্য। যখন এই দশ ভাই খাদ্যশস্য ক্রয়ের জন্য হযরত ইউসুফ আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমতে উপস্থিত হলেন তখন হযরত ইউসুফ আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ১০ ভাইকে দেখে চিনে ফেললেন। কিন্তু তারা কিছুতেই হযরত ইউসুফ আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে চিনতে পারলো না। কারণ তারা ভেবেছিল এত দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে হযরত ইউসুফ আলাইহিস সাল্লাম হয়তোবা মারা গেছেন বা হারিয়ে গেছে। হযরত ইউসুফ আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এমন শাহিন পোশাক পরা অবস্থায় তারা কখনো কল্পনাই করতে পারেনি যে ইনি তাদের সেই ছোট্ট ভাই হযরত ইউসুফ আলাইহি ওয়াসাল্লাম হবেন। তারাই ইব্রানি ভাষায় হযরত ইউসুফ আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে কথা বললেন এবং হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম ও ইবরানী ভাষা জানতেন। হযরত ইউসুফ আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন যে তোমরা কোথা হতে এসেছ? প্রশ্নের জবাবে তারা বলল আমরা সিরিয়া শহর থেকে এসেছি আমাদের সিরিয়াতে মহাদুর্ভিক্ষ পতিত হয়েছে। তাই আমরা এসেছি আপনার কাছে খাদ্য ক্রয় করতে।


হযরত ইউসুফ আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে প্রশ্ন করলেন, তোমরা গোয়েন্দা নাতো? তখন তারা কসম করে বলল না না আমরা গোয়েন্দা নই। আমরা সবাই আপন ভাই এবং এক বাপের সন্তান আমরা। আমাদের বাবা একজন বড় বুজুর্গ ব্যক্তি এবং আল্লাহর একজন নবী। অতঃপর তিনি জিজ্ঞাসা করলেন তোমরা কয় ভাই? তারা বলল আমরা ১২ ভাই ছিলাম। কাজের মধ্যেও আমাদের এক ভাই জঙ্গলে হারিয়ে যায়। সে আমাদের আব্বাজানের সবচেয়ে প্রিয় সন্তান ছিল। তার আপন ভাই কে আমাদের আব্বা রেখে দিয়েছেন। এতে করে তিনি মনে একটু শান্তি অনুভব করেন।


হযরত ইউসুফ আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই ১০ ভাইকে খুব আদর আপ্যায়ন করলেন। অবশেষে প্রত্যেক ভাইকে একটি করে উট বোঝাই খাদ্যশস্য দিলেন। পথের যাতে কোনো সমস্যা না হয় সে জন্য খাদ্য সামগ্রী দিলেন। সবশেষ বিদায়বেলায় বললেন পরের বার যখন তোমরা আসবে তখন তোমাদের সেই ভাই কেউ নিয়ে আসবে যেন সেও আরেকটি অতিরিক্ত উট বোঝাই খাদ্যশস্য নিয়ে যেতে পারে। আর যদি তোমরা ওকে আনতে না পারো তাহলে তোমরাও আর কোন খাদ্য সামগ্রী পাবেনা। আর এদিকে হযরত ইউসুফ আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর খাদেমদেরকে বললেন যেন খাদ্যশস্য বাবদ যে টাকা নেয়া হয়েছিল সেটা যেন সেই খাদ্যশস্য বোঝাই উট এর মাঝে দিয়ে দেয়া হয়।


তারপর তারা ১০ ভাই খাদ্যশস্য নিয়ে কেনান শহরে ফিরে এলো এবং মিশরের বাদশার খুব প্রশংসা করতে লাগলো। তারা তাদের পিতা হযরত ইয়াকুব আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে সমস্ত ঘটনা খুলে বললো। তারপর তারা খাদ্যশস্য বোঝাই উট থেকে বস্তাগুলো নামিয়ে খুলে দেখতে লাগলো। এবং তারা দেখতে পেল সেই বস্তা গুলোর ভিতরে তাদের দেয়া টাকাগুলো রয়ে গেছে। তারা হযরত ইয়াকুব আলাই সাল্লাম কে বলল আব্বা জান এই বাদশাহ তো অনেক বড় দয়ালু এবং দানশীল। আব্বাজান দেখুন আমরা খাদ্যশস্য বাবদ যে টাকাগুলো দিয়েছিলাম এটা এই বাদশা ফেরত দিয়ে দিয়েছে। শুধু তাই নয় উনি এও বলে দিয়েছেন যে, পরেরবার আমরা যখন খাদ্যশস্য কেনার জন্য সেই বাচ্চার কাছে যাব তখন যেন আমরা আমাদের আরেক ভাই বেনিয়ামীনকে সাথে করে নিয়ে যাই। এবং তিনি এটাও বলে দিয়েছেন যে আমরা যদি বেনিয়ামীনকে নিয়ে না যায় তাহলে উনি আর খাদ্যশস্য দিবেন না। সুতরাং আব্বাজান আপনি পরেরবার বেনিয়ামীনকে আমাদের সাথে দিবেন যাতে করে সে তার ভাগের খাদ্যশস্য টুকু নিতে পারে। কথা শুনে হযরত ইয়াকুব আলাই সাল্লাম তাদেরকে বললেন এর আগের বার বেঞ্জামিনের ভাই ইউসুফকে তোমাদের সাথে দিয়ে ছিলাম। এবার বেনিয়ামীনকে দিয়ে তোমাদের উপর কিভাবে ভরসা করতে পারি। ওরা বলল আব্বাজান আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি আমরা নিশ্চয়ই ওর হেফাজত করব। আপনি কোন রকম দুশ্চিন্তা করবেন না। তারপর অনেক অনুনয় বিনয় পড়ার পর হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সাল্লাম বললেন, ঠিক আছে, আল্লাহ হেফাজতকারী পরেরবার তোমরা বেনিয়ামীনকে সাথে নিয়ে যেতে পারবে। অতঃপর এরা বেনিয়ামীনকে নিয়ে পুনরায় মিশরে গেল এবং ইউসুফ আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরবারে হাজির হয়ে বলল, জনাব আমাদের একাদশ ভাইকেও আমরা আমাদের সাথে নিয়ে এসেছি। হযরত ইউসুফ আলাইহিস সাল্লাম খুবই খুশি হলেন এবং ওদের সাদর সম্ভাষণ জানালেন এবং শাহী ভোজের ব্যবস্থা করে এক লম্বা দস্তরখানা বিছিয়ে সামনাসামনি দুজন দুজন করে বসতে বললেন। অতঃপর ওরা ১০ ভাই দুজন দুজন করে বসে গেলেন। বিন ইয়ামিন একাকী রয়ে গেল। তখন হযরত ইউসুফ আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওদেরকে লক্ষ্য করে বললেন, তোমাদের এক ভাই তো একাকী রয়ে গেল। সেহেতু আমি ওকে আমার সাথে বসাচ্ছি। অতএব বেনিয়ামিন এর সাথে হযরত ইউসুফ আলাই সাল্লাম নিজেই বসে গেলেন এবং ওকে বললেন তোমার হারানো ভাই ইউসুফ এর জায়গায় যদি আমি তোমার আপন ভাই হয়ে যাই তাহলে কি তুমি পছন্দ করবে? কথা শুনে বেনিয়ামিন বললেন সুবাহানাল্লাহ। আপনার মত যদি ভাই পাওয়া যায় তাহলে বড় সৌভাগ্যের বিষয়। হযরত ইয়াকুব এর কলিজার টুকরা ও রাহিলের নয়নমণি তো আর আপনি হতে পারেন না। ইউসুফ আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কথা শুনে কেদে দিলেন এবং বেনিয়ামীনকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন আর বললেন আমি তোমার আপন ভাই ইউসুফ। আর শোনো ইরা যা কিছু করেছে তার জন্য মন খারাপ করোনা কারণ এটা আল্লাহর বড় অনুগ্রহ যে তিনি আমাদেরকে একত্রিত করেছেন। আরো বললেন এ রহস্যের কথা তার ভাইদের যেন না বলে। এ কথা শোনার পর বেনিয়ামিন আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল।


শিক্ষা: আল্লাহ ওয়ালা গন শত্রুতা কারীদের সাথে ভালো ব্যবহার করে থাকেন। তাদের কখনো অপকার করেন না বরং বিপদে-আপদে তাদের উপকার করে থাকেন।


0 comments:

Post a Comment